বিবেক – আয়নায় আটকে থাকা সমাজের মুখ
ইকবাল জিল্লুল মজিদ
পরিচালক, কমিউনিটি হেলথ প্রোগ্রাম
রাডডা এমসিএইচ-এফপি সেন্টার, মিরপুর ১০, ঢাকা ১২১৬
বিবেক—শব্দটি শুনলেই মনের ভেতর এক ধরনের নরম আলো জ্বলে ওঠে। যেন গভীর রাতে একা দাঁড়িয়ে থাকা একটি বাতিঘর, যার আলো আছে, দিকনির্দেশনা আছে, কিন্তু সেখানে পৌঁছাতে গিয়ে বহুবার পা হড়কে যায়।
আজকের সমাজে এই ‘বিবেক’ ঠিক কতটা জীবন্ত, আর কতটা যাদুঘরের মৃত শিল্প হয়ে গেছে—সেটাই বড় প্রশ্ন।
একটা সময় ছিল, যখন কারো ভুলে অন্যের হৃদয় ক্ষতবিক্ষত হলে, “ভুল করেছি” বলাটা সাহসের পরিচয় ছিল। এখন? এখন দোষী চুপ করে থাকে, আর বাকিরা মুচকি হেসে কফি খায়—তাদের বিবেক ক্লাউডে আপলোড হয়ে গেছে, ডাউনলোড করার সময় নেই!
রাস্তায় কেউ পড়ে গেলে, আগে মোবাইল ক্যামেরা ওঠে; হাত বাড়িয়ে তোলার কথা পরে আসে—কিংবা অনেক সময় আসে-ই না। এই ‘দর্শক সমাজে’ বিবেক এক ধরনের ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হয়ে গেছে—শোনা যায়, কিন্তু কেউ মনোযোগ দেয় না। তবুও সেটা বাজতেই থাকে।
বিবেক শুধু ব্যক্তির নয়, রাষ্ট্রেরও থাকা জরুরি। কিন্তু আজকের রাষ্ট্রের বিবেক অনেকটা বিজ্ঞাপনের মতো—যেখানে বাস্তবতা নয়, ইমেজই মুখ্য। এক ক্ষুধার্ত মানুষ সরকারকে দেখে না, সে দেখে দেয়ালে লাগানো বিলবোর্ড—‘আমরা উন্নয়নের পথে’, আর সে হাঁটে উল্টো দিকে; পেছনে পড়ে থাকা গর্তগুলো টপকাতে টপকাতে।
স্কুলে আমরা “সততা” শিখি, কিন্তু পরীক্ষায় “প্রশ্নপত্র ফাঁস” করে পাশ করি। অফিসে “নৈতিকতা” নিয়ে সেমিনার হয়, আর ঘুষের হিসাব চলে ক্যালকুলেটরে। তাহলে কোথায় গেল সেই বিবেক? নাকি এখন তা হয়ে গেছে কাস্টমাইজড—”নিজের সুবিধামতো জাগে, আর অসুবিধায় ঘুমায়”?
তবুও মাঝেমধ্যে কিছু মানুষ, কিছু মুহূর্ত আমাদের বিবেককে নাড়া দেয়। যেমন—একটি ছোট্ট ছেলে বা মেয়ে নিজের টিফিন ভিখিরির পাতে রেখে দেয় নিঃস্বার্থভাবে। তখন মনে হয়, বিবেক মরে যায়নি—সে শুধু ক্লান্ত, একটু আদর খুঁজছে।
পরিশেষে:
যদি বিবেক হয় আয়নার মতো, তবে সমাজ সেই আয়নায় নিজের মুখ দেখতে ভয় পায়। কারণ সেখানে সৌন্দর্যের নয়, সত্যের প্রতিফলন ঘটে।
আর যতদিন সত্যকে অস্বীকার করব, ততদিন বিবেক থাকবে শুধু বইয়ের পাতায়—না বলা কবিতার ছায়ায়।
তবুও আশাবাদী হওয়া যায়—কারণ বিবেক কখনো মরে না। সে শুধু অপেক্ষা করে—একটা চেতনার, একটা সাহসের, আর একটা বিপ্লবের।