পূর্বপরিকল্পনার ঊর্ধ্বে একটি বিস্ফোরণ — ‘জুলাই ২০২৪ আন্দোলন’ ছিল জনতার স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান
– ইকবাল জিল্লুল মজিদ
পরিচালক, কমিউনিটি হেলথ প্রোগ্রাম, রাডডা এমসিএইচ-এফপি সেন্টার
ভূমিকা
জুলাই-আগস্ট ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনন্য ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়, যা কোনো রাজনৈতিক দলের ছায়া বা পূর্বপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রে নয়—বরং জনমানুষের দীর্ঘদিনের ক্ষোভ, বঞ্চনা ও হতাশার আত্মদ্রোহী প্রতিক্রিয়ায় আত্মপ্রকাশ ঘটায়। এটি ছিল সময়োচিত, সচেতন এবং স্বতঃস্ফূর্ত এক জাগরণ।
পটভূমি
গত এক দশকে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানে দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন এবং গণতান্ত্রিক চর্চার অভাব প্রকট হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী ও নবীন চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে ভবিষ্যৎ নিয়ে এক গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়।
২০১৮ সালের কোটা সংস্কার ও নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল, তার বাস্তব প্রতিফলন রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে দেখা যায়নি। বরং দমননীতি ও প্রতিহিংসাপরায়ণতার মাধ্যমে সেই চেতনা স্তব্ধ করার চেষ্টা চলে। কিন্তু সমাজের গভীরে অসন্তোষের যে আগুন তখন জ্বলছিল, তার অগ্নিপিণ্ডই বিস্ফোরিত হয় ২০২৪ সালের জুলাইয়ে।
আন্দোলনের আরম্ভ ও বিস্তার
২০২৪ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিক্ষোভ শুরু হয়। মূলত বেতন বৃদ্ধি, চাকরির সংকট, বিদ্যুৎ পরিস্থিতি এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রতিবাদে তারা রাস্তায় নামে। এই ক্ষোভ অল্প সময়েই রাজধানী থেকে ছড়িয়ে পড়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তিক অঞ্চলে।
চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল—সব জেলায় ছাত্র-জনতা একাত্ম হয়ে রাস্তায় নামেন। শহর থেকে গ্রাম, একটাই স্লোগান—“এই দেশ আমাদের, আমাদের বাঁচতে দাও।” সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আন্দোলনের বার্তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। কোনো দলীয় সংগঠন বা নির্দিষ্ট নেতার অনুমোদন ছাড়াই আন্দোলন বিস্তার লাভ করে—এটিই ছিল এ আন্দোলনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
কেন এটি পূর্বপরিকল্পিত ছিল না?
১. নেতৃত্বহীনতাই নেতৃত্ব:
আন্দোলনে কোনো একক নেতা ছিল না। ছাত্ররাই দায়িত্ব নিয়ে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রেখে আন্দোলন পরিচালনা করে। এটি ছিল সমন্বয়হীন, কিন্তু লক্ষ্যনির্দিষ্ট।
২. সংগঠনের অভাবেই সংগঠন:
কোনো রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন কিংবা শ্রমিক ইউনিয়নের ব্যানার ছাড়াই গণসাধারণের অন্তর্জাগৃতি থেকেই এই সংগঠিত প্রতিবাদ গড়ে ওঠে।
৩. সহিংসতা নয়, প্রতিবাদের সৃজনশীলতা:
গান, কবিতা, দেয়াল লিখন, নাট্যাংশ—এসবকেই প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ যে এত বিস্তৃত ও প্রাণবন্ত হতে পারে, তা পূর্বপরিকল্পিত হলে সম্ভব হতো না।
৪. প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ও বিভ্রান্তি:
প্রশাসন শুরুতে একে ‘অরাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা’ আখ্যা দিয়ে উপেক্ষা করে। কিন্তু যখন দমন-পীড়নের কৌশলে আন্দোলন দমন করা যায়নি, তখনই স্পষ্ট হয়ে যায়—এটি একটি অন্তর্জাত গণআন্দোলন।
আন্দোলনের তাৎপর্য
এই আন্দোলনের সবচেয়ে বড় অর্জন ছিল জনগণের আত্মবিশ্বাসের পুনর্জাগরণ। মানুষ বুঝে যায়, বড় কোনো রাজনৈতিক দলের মুখাপেক্ষী না হয়ে নিজেরাই পরিবর্তনের চালক হতে পারে।
তরুণদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা এই আন্দোলন একটি নতুন রাজনৈতিক চেতনার জন্ম দেয়—যেখানে নেতৃত্ব জন্ম নেয় রাস্তায়, এবং আদর্শ গড়ে ওঠে অভিজ্ঞতা ও সত্যের মাটিতে দাঁড়িয়ে।
পরিশেষে
‘জুলাই ২০২৪ আন্দোলন’ ছিল একটি যুগান্তকারী মোড়। এটি প্রমাণ করে, গণজাগরণ কখনো পরিকল্পনার ওপর নির্ভরশীল নয়। যখন জনগণ উপলব্ধি করে—তারা শোষিত, বঞ্চিত ও প্রতারিত, তখনই ইতিহাসে ঘটে এমন স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যুত্থান।
এটি পূর্বপরিকল্পনার চেয়ে অনেক বেশি আত্মিক ও যৌক্তিক প্রতিক্রিয়া ছিল। ভবিষ্যতের বাংলাদেশে যদি গণতন্ত্র, ন্যায় ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হয়, তবে এমন জাগরণকে কণ্ঠরোধ না করে বরং বুঝতে হবে, সম্মান করতে হবে, এবং শিক্ষা নিতে হবে।
হাসান মাহমুদ সংগৃহীত