1. dailyrodrodipto@gmail.com : রৌদ্রদীপ্ত : রৌদ্রদীপ্ত
  2. info@www.newsbddailyrodrodipto.online : রৌদ্রদীপ্ত :
বৃহস্পতিবার, ১৪ অগাস্ট ২০২৫, ০৩:১২ পূর্বাহ্ন

‘কিশোর গ্যাং’: বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার নীরব বিস্ফোরণ / ইকবাল জিল্লুল মজিদ পরিচালক, কমিউনিটি হেলথ প্রোগ্রাম রাডডা এমসিএইচ এফপি সেন্টার

  • প্রকাশিত: শুক্রবার, ৪ জুলাই, ২০২৫
  • ২৩২ বার পড়া হয়েছে

‘কিশোর গ্যাং’: বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থার নীরব বিস্ফোরণ

ইকবাল জিল্লুল মজিদ
পরিচালক, কমিউনিটি হেলথ প্রোগ্রাম
রাডডা এমসিএইচ এফপি সেন্টার

প্রারম্ভিকা:
একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার শিশু ও কিশোরদের উপর। অথচ গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের শহর, বন্দর, এমনকি মফস্বল অঞ্চলেও যে বিষয়টি ভয়াবহ হুমকিতে রূপ নিয়েছে তা হলো – ‘কিশোর গ্যাং’। সমাজের চোখে তারা আজ অপরাধী, পরিবারে তারা অসহায়, রাষ্ট্রের চোখে তারা এক জটিল প্রশাসনিক সমস্যা। কিন্তু এই কিশোরেরা তো হঠাৎ করে এমন হয়ে ওঠেনি! প্রশ্ন হচ্ছে, কে গড়লো এই কিশোর গ্যাং? কীভাবে তারা গড়ে উঠলো? আর আমরা সবাই, যারা সমাজের নানা স্তরে দায়িত্বে আছি—আমরা কী করছি?

উত্থানের পেছনের সামাজিক বাস্তবতা:

১. পারিবারিক ভাঙন ও নজরদারির অভাব:
অধিকাংশ কিশোর গ্যাং সদস্য আসে নিম্ন-মধ্যবিত্ত বা নি¤œবিত্ত পরিবার থেকে। অভিভাবকরা জীবিকার তাগিদে সারাদিন বাইরে থাকেন। পরিবারে সঠিক মূল্যবোধ শেখানোর সুযোগ কমে গেছে। বাবা-মায়ের সময় না পাওয়ায় কিশোরেরা নেমে পড়ছে রাস্তায়, জড়িয়ে পড়ছে অপরাধে।

২. শিক্ষাব্যবস্থার সংকট ও ড্রপ-আউট:
সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য, শিক্ষার মানহীনতা, সহিংসতা এবং স্কুলে-বাইরে বুলিংয়ের শিকার হয়ে অনেকেই স্কুল ছেড়ে দেয়। পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে তারা রাস্তার ‘বন্ধুত্ব’ বেছে নেয়।

৩. প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার:
স্মার্টফোনের সহজলভ্যতা এবং নজরদারিহীন ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণে তারা ভার্চুয়াল গ্যাং কালচারে আকৃষ্ট হচ্ছে। টিকটক, ফেসবুক, ইউটিউব থেকে তারা গ্রহণ করছে সহিংসতা, দাপট, বেপরোয়া জীবনের ধারণা।

৪. রাজনীতি ও ‘পৃষ্ঠপোষকতা’:
কিছু রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি নিজেদের স্বার্থে কিশোরদের ব্যবহার করছে মিছিল-মিটিং, দখল, চাঁদাবাজিতে। একসময় এদের ‘ক্যাডার’ বানিয়ে ফেলে সমাজেরই ভয়ংকর অস্ত্রে পরিণত করা হয়।

সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ:

সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন—সমাজে যখন শিশু-কিশোরদের জন্য নিরাপদ বিকাশের পরিবেশ থাকে না, তখন তারা ‘বিকল্প সমাজ’ তৈরি করে। কিশোর গ্যাং সেই বিকল্প সমাজের প্রতিচ্ছবি। তারা একে অপরের প্রতি ‘ভাই’, ‘ডন’, ‘প্রোটেকশন’ ইত্যাদি বন্ধন দিয়ে যুক্ত থাকে, যা আসলে একটি ‘ছায়া সমাজ’ গঠন করে।

এটা কেবল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ না, বরং একটি ব্যর্থ সামাজিক কাঠামোর বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়া।

আমাদের সম্মিলিত দায়:

► পরিবার:
শিশুদের মানসিক ও নৈতিক শিক্ষা দিতে হবে। তাদের সাথে সময় কাটাতে হবে, তাদের বন্ধুত্বের জগৎ জানতে হবে।

► শিক্ষা প্রতিষ্ঠান:
শুধু পাঠদান নয়, বরং বিদ্যালয়গুলোতে মানসিক স্বাস্থ্য, নৈতিকতা, সহনশীলতা নিয়ে কার্যকর কর্মসূচি থাকতে হবে। কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।

► সমাজ ও মিডিয়া:
গ্যাং কালচারকে গ্ল্যামারাইজ করে এমন টিভি, ইউটিউব কনটেন্ট বন্ধ করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সংস্কৃতি চর্চা, খেলাধুলা, স্কিল ট্রেইনিং চালু করা জরুরি।

► ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান:
মসজিদ, মন্দির, গির্জা বা প্যাগোডা – সবখানে শিশু-কিশোরদের জন্য মানবিক মূল্যবোধ শেখানো উচিত। ভয়ভীতি নয়, বরং ভালোবাসা দিয়ে পথ দেখানো জরুরি।

► রাজনৈতিক দল:
তরুণদের ব্যবহার নয়, বরং তাদের নেতৃত্ব বিকাশে সহায়ক হতে হবে। রাজনৈতিক স্বার্থে কিশোরদের ব্যবহার এক ধরনের মানসিক শোষণ।

সমাধানে করণীয় – সমাজবিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে:

১. ন্যাশনাল ইয়ুথ কাউন্সেলিং নেটওয়ার্ক গঠন করা, যেখানে রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি পর্যায়ে কিশোরদের জন্য মনস্তাত্ত্বিক সহায়তা থাকবে।

২. স্কুল পর্যায়ে গ্যাং সচেতনতা প্রোগ্রাম চালু করা, যেন তারা গ্যাংয়ের ছত্রছায়া বুঝতে পারে ও প্রতিরোধ করতে শেখে।

৩. জেল নয়, সংশোধনাগার ও পুনর্বাসন কেন্দ্র গড়ে তোলা, যেখানে কিশোর অপরাধীদের মানবিকভাবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা থাকবে।

৪. পিতামাতার জন্য সচেতনতামূলক কর্মশালা, যেন তারা প্রযুক্তি, ইন্টারনেট, মানসিক স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ে শিশুদের প্রয়োজন বুঝতে পারেন।

৫. অবসর সময়ে শিশুদের জন্য বিকল্প ব্যবস্থা (স্কাউটিং, নাট্যচর্চা, খেলাধুলা, কারিগরি শিক্ষা ইত্যাদি) চালু করা।

পরিশেষে:
আজকের কিশোর গ্যাং আসলে আমাদের সমাজেরই একটি প্রতিবিম্ব—যেখানে পরিবার ব্যর্থ, শিক্ষা দুর্বল, মূল্যবোধ ক্ষয়িষ্ণু, এবং রাষ্ট্র উদাসীন। যদি এখনই পুরো সমাজ একসঙ্গে না জাগে, তবে আগামী এক দশকে কিশোর গ্যাং এক ভয়াবহ সামাজিক বিস্ফোরণে পরিণত হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, “একজন কিশোর যদি সমাজের পথ না পায়, তবে সে সমাজের বিপদে পরিণত হয়।” এখন সময়, কিশোরদের শুধরে দেয়ার—ধ্বংসের আগেই গড়ে তোলার।

আরো সংবাদ পড়ুন

পুরাতন সংবাদ পড়ুন

© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত -২০২৫, আমাদের প্রকাশিত সংবাদ, কলাম, তথ্য, ছবি, কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার দণ্ডনীয় অপরাধ।
ওয়েবসাইট ডিজাইন : ইয়োলো হোস্ট