নীরব ঘাতক: গাছ কাটা ও আমাদের অস্তিত্বের সংকট:বাংলাদেশ একসময় ছিল সবুজ-শ্যামল ভূমি। কিন্তু এখন প্রতিদিন, প্রতিক্ষণে, উদ্দেশ্যহীন বা ক্ষুদ্র স্বার্থে দেশের শত শত গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। এই ধ্বংস শুধু পরিবেশের নয়, এটি এক নীরব আত্মহননের পথে জাতিকে ঠেলে দিচ্ছে।আমরা কি জানি, গাছ কাটা শুধু তাপ বাড়ায় না—এর প্রভাব পড়ে মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে? আমাদের অচেতনতা, রাষ্ট্রের অবহেলা, আর ব্যবসায়িক লোভ আজ এমন এক বাস্তবতা সৃষ্টি করেছে, যেখানে গাছ হারানোর অর্থ হলো ভবিষ্যৎ হারানো।
গাছ কাটা: পরিকল্পনাহীন উন্নয়ন না পরিবেশগত অপরাধ?রাস্তা নির্মাণ, আবাসন ব্যবসা, ইটভাটা, অবৈধ কাঠ ব্যবসা কিংবা প্রশাসনিক প্রকল্প—সবখানেই গাছ যেন একটি অনাবশ্যক জিনিসে পরিণত হয়েছে।শহরের প্রতিটি ফুটপাথ, প্রত্যন্ত এলাকার প্রতিটি বাগান, এমনকি বনাঞ্চলেও নির্বিচারে চলছে গাছ কাটা। পরিকল্পিত পুনঃরোপণের কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেই। কোথাও কোথাও একটিও গাছ না রেখেই সমগ্র এলাকা কংক্রিটে পরিণত করা হচ্ছে।
জলবায়ু ও প্রকৃতিতে প্রতিক্রিয়াগত ত্রিশ বছরে দেশের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় এক দশমিক পাঁচ ডিগ্রি সেলসিয়াস দেশে বছরে গড়ে চরম তাপপ্রবাহের দিন বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি বর্ষাকালে বৃষ্টিপাত অনিয়মিত, কখনো অতিরিক্ত, কখনো ভয়াবহ খরাপ রিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে বিপন্ন হচ্ছে জীববৈচিত্র্য
বহুমাত্রিক প্রভাব: মানুষের জীবনে কোথায় কোথায় চাপ পড়ছে?
স্বাস্থ্যখাতে - তাপঘাত, পানিশূন্যতা, শ্বাসকষ্ট, হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে।শিশু, বৃদ্ধ ও দিনমজুররা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে।গরমে মানসিক চাপ ও ঘুমহীনতা বাড়ছে।
কৃষিখাতে -গরমে ফসলের সময়চক্র বিঘ্নিত হচ্ছে।খরার কারণে জলাধার শুকিয়ে যাচ্ছে, সেচব্যবস্থা ব্যাহত উৎপাদন কমে গিয়ে খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে নগর জীবন ও বাসযোগ্যতা।শহরে গরমের তীব্রতায় জনজীবন অস্থির। বিদ্যুৎচাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে, বাড়ছে লোডশেডিং।সড়কে গাছ না থাকায় ছায়া নেই, পথচলার কষ্ট ভয়াবহ।
শিক্ষা ও শিশু বিকাশ-প্রচণ্ড গরমে স্কুলে উপস্থিতি কমে যাচ্ছে।শিশুরা বাইরে খেলা করতে পারছে না, মানসিক বিকাশে বাধা।শিক্ষকদেরও শিক্ষাদান ব্যাহত হচ্ছে পরিবেশের অসহনীয় তাপে।অর্থনীতি ও কর্মসংস্থান কৃষি, পরিবহন, নির্মাণসহ খোলা জায়গায় কাজ করা পেশাগুলো ক্ষতিগ্রস্ত।উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে, মজুরি বেড়েও শ্রমিক পাচ্ছে না।সরকারি-বেসরকারি খাতে স্বাস্থ্য ও বিদ্যুৎ খাতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য - পাখি, কীট-পতঙ্গ, বনজ প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে।মাটির উর্বরতা কমছে, বনজ সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে।বাতাসে অক্সিজেনের মাত্রা কমছে, ধুলাবালির মাত্রা বেড়েছে করণীয় ও দায়িত্ব -
১. গাছ কাটার বিকল্প ভাবনা আনতে হবে উন্নয়ন পরিকল্পনায় গাছ সংরক্ষণের বাধ্যবাধকতা যুক্ত করতে হবে।
২. বনায়ন কার্যক্রমকে জাতীয় আন্দোলনে রূপ দিতে হবে প্রতিটি নাগরিক যেন বছরে অন্তত একটি গাছ লাগায় ও পরিচর্যা করে।
৩. শিক্ষা ও সচেতনতার বিস্তার ঘটাতে হবে মিডিয়া, সামাজিক প্ল্যাটফর্ম ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গাছের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে
৪. কঠোর আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে যারা অবৈধভাবে গাছ কাটে, তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।
৫. স্থানীয় সরকার ও তরুণ সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও পৌরসভা পর্যায়ে বৃক্ষ সংরক্ষণ কমিটি গঠন করা যায়।
চূড়ান্ত উপলব্ধি - গাছ কাটার প্রতিটি ঘটনা যেন একটি চুপচাপ ফেলে যাওয়া বোমা—যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরিত হয়ে ধ্বংস করছে আমাদের জলবায়ু, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি ও ভবিষ্যৎ।একটি গাছ মানে একটি ছায়া নয়—একটি প্রাণ, একটি নিঃশ্বাস, একটি ভবিষ্যৎ।আমরা যদি এখনই না থামি, তবে শিগগিরই আমরা এমন একটি বাংলাদেশে পরিণত হব, যেখানে থাকবে শুধু খরতাপ, ধুলাবালি আর নীরব হাহাকার।আসুন, এখনই গাছের দিকে ফিরে যাই—নয়তো গাছের শূন্যতাই একদিন আমাদের মৃত্যুবার্তা হয়ে আসবে।
(ইকবাল জিল্লুল মজিদ,পরিচালক, কমিউনিটি হেলথ প্রোগ্রাম, রাডডা এমসিএইচ-এফপি সেন্টার।)
সংগ্রহ - আমির হোসেন