এক রাষ্ট্র, দুই নীতি: বৈষম্যের ছায়ায় বাংলাদেশ:
(ইকবাল জিল্লুল মজিদ, পরিচালক কমিউনিটি হেলথ প্রোগ্রাম, রাডডা এমসিএইচ এফপি সেনটার)
বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতি ও শাসনব্যবস্থা বর্তমানে এমন এক দ্বিমুখী বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে, যেখানে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, মধ্যবিত্ত এবং ধনীক শ্রেণীর জন্য রাষ্ট্রের আচরণ ভিন্ন। এই ভিন্নতা শুধু নীতি বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে সীমাবদ্ধ নয় এটি ছুঁয়ে গেছে বিচার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার প্রতিটি স্তরে। ফলাফল – একই দেশে বসবাস করেও কেউ বঞ্চনার ভারে নুয়ে পড়ছে, আবার কেউ রাষ্ট্রক্ষমতার ছায়াতলে নিরাপদ ও প্রভাবশালী হয়ে উঠছে।
রাষ্ট্রের মুখোশ: প্রান্তিক জনগণের জন্য কঠোর, ধনীদের জন্য সহনশীল –
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি রাষ্ট্রের মনোভাব প্রায়শই উপেক্ষামূলক, কখনো কখনো দমনমূলক। ভূমিহীন কৃষক, গার্মেন্টস শ্রমিক, খেটে খাওয়া মানুষ এদের মৌলিক অধিকার যেমন বাসস্থান, ন্যায্য মজুরি বা স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার প্রশ্নে সরকার নির্বিকার। অন্যদিকে, ধনী ও প্রভাবশালীদের অবৈধ অর্থপাচার, ভর্তুকি হরণ, ব্যাংক লুট সবই চলছে নির্বিঘ্নে, অনেক সময় সরকারের নীরব সম্মতির মধ্য দিয়ে। বিচার ও প্রশাসনে দ্বিমুখিতা –
বিচার ব্যবস্থায়ও এই বৈষম্য প্রকট। সাধারণ মানুষের মামলা বছরের পর বছর ঝুলে থাকে, অথচ রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক ক্ষমতাবানদের জন্য রাতারাতি জামিন, মামলার নিষ্পত্তি, কিংবা ক্ষমা আদায়—সবই সম্ভব হয়। প্রশাসনিক পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক শ্রেণিকে আরও দুর্বল ও অসহায় করে তোলে।
শিক্ষা ও স্বাস্থ্য: সুযোগ সীমিত, বৈষম্য সীমাহীন
সরকারি স্কুল-কলেজ ও হাসপাতালের জীর্ণ দশা যেন কেবল প্রান্তিক ও মধ্যবিত্তের জন্যই। ধনীদের জন্য রয়েছে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়, বিদেশে পড়াশোনার সুযোগ, আন্তর্জাতিক মানের ক্লিনিক। অথচ এই প্রাইভেট খাতগুলোর বেশিরভাগই রাষ্ট্রের ট্যাক্স ছাড়, বিশেষ সুবিধা ও নীতিগত সুরক্ষা পেয়ে ফুলে-ফেঁপে উঠেছে।
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব ও দ্বিচারিতা:
ক্ষমতাসীন দল বা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি — উভয়েই যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন তারা ভিন্ন ভিন্ন মুখোশ পরিধান করে। সাধারণ মানুষের সামনে ন্যায়-নৈতিকতার বুলি আওড়ালেও, বাস্তবতা হলো তারা ধনীদের সঙ্গে আঁতাত করে প্রান্তিকদের স্বপ্ন ও অধিকার হরণ করে। নীতিনির্ধারণে জনগণের মত বা অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে।
মধ্যবিত্তের নিঃশব্দ মৃত্যু:
মধ্যবিত্ত শ্রেণি, যারা দেশের উৎপাদন, শিক্ষা, ও সংস্কৃতির চালিকাশক্তি, তারা আজ সবচেয়ে বেশি কোণঠাসা। রাষ্ট্রপ্রশাসনের পক্ষপাত, নীতিনির্ধারণে অবজ্ঞা এবং জীবিকার অনিশ্চয়তা তাদের হতাশ ও বিক্ষুব্ধ করে তুলছে। প্রান্তিকের মতো সরকারি সাহায্য পায় না, ধনীদের মতো সুযোগও নেই এই শ্রেণির অবস্থা যেন “উঁচুতে ঠেকা, নিচে ঠোকা”।
একটি ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্রের প্রয়োজন:একটি রাষ্ট্রের মৌলিক চরিত্র হওয়া উচিত সমতা, ন্যায় ও অন্তর্ভুক্তি। কিন্তু যখন সেই রাষ্ট্রই বৈষম্যকে পুষ্ট করে, তখন তা হয়ে ওঠে শোষণের যন্ত্র। বাংলাদেশ আজ সেই পথেই হাঁটছে যেখানে ‘এক রাষ্ট্র, দুই নীতি’ বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে গণঅসন্তোষ, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও ঘনীভূত হবে।তাই এখনই প্রয়োজন জবাবদিহিমূলক, অংশগ্রহণমূলক এবং মানবিক রাষ্ট্র পরিচালনার। এক রাষ্ট্রে সবাই নাগরিক কিন্তু যখন কারও জন্য আইন শক্তিশালী, আর কারও জন্য নমনীয় তখন সেটি গণতন্ত্র নয়, সেটি শোষণের আধার।
সংগ্রহ – আমির হোসেন