বাংলাদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মানবিক বিড়ম্বনা:
(ডা.ইকবাল জিল্লুল মজিদ)
বাংলাদেশের উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় আমরা অনেকদূর এগিয়ে গেলেও সমাজের প্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর কথা এখনো চাপা পড়ে আছে। এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আজও বঞ্চনার ঘেরাটোপে বন্দী। রাজনীতির মাঠে প্রতিশ্রুতির ফুলঝুরি থাকলেও বাস্তবে তাদের জীবনে উন্নতির ছোঁয়া লাগে না। ক্ষমতায় যাওয়ার পর রাজনৈতিক দলগুলো নিজের তল্পিতল্পা গুছিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, আর প্রান্তিক মানুষেরা থেকে যায় কেবল ভোটের মৌসুমি ফসল হিসেবে।
বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কারা?বাংলাদেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী বলতে বোঝানো হয় সেই সব জনগোষ্ঠীকে, যারা সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিকভাবে দীর্ঘদিন ধরে অবহেলিত, নিগৃহীত ও বঞ্চিত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য:
১. আদিবাসী জনগোষ্ঠী – যেমন সাঁওতাল, মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা, গারো, মুণ্ডা, বানাই, রাখাইন প্রভৃতি।
২. হিজড়া ও রূপান্তরকামী জনগোষ্ঠী – সামাজিকভাবে বর্জিত ও সম্মানহীন জীবনের শিকার।
৩. বেদে ও নৌচর জনগোষ্ঠী – স্থায়ী বাসস্থানহীন, শিক্ষা ও চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত।
৪. চা-বাগানের শ্রমিক সম্প্রদায় – সর্বনিম্ন মজুরি ও স্বাস্থ্য-শিক্ষা বঞ্চনায় জীবন কাটে।
৫. দলিত ও হরিজন জনগোষ্ঠী – সুইপার, মেথর, ম্যানহোল কর্মী যারা এখনো জাতপাত ভিত্তিক বৈষম্যের শিকার।
৬. ভূমিহীন কৃষক ও দিনমজুর – যাদের শ্রমে রাষ্ট্র চলে, অথচ তারাই সবচেয়ে অনিরাপদ।
৭. জেলে সম্প্রদায় – নদী, হাওর ও সমুদ্র নির্ভর এই গোষ্ঠী জলবায়ু পরিবর্তন ও দালালচক্রে নিঃস্ব।
৮. নিম্নবিত্ত মুসলিম ও সংখ্যালঘু ধর্মীয় সম্প্রদায় – বৈষম্য, সহিংসতা ও রাজনৈতিক অবহেলার শিকার।
৯. নারী, বিশেষ করে বিধবা, একক মা ও গৃহকর্মীরা – যাদের শ্রমের মূল্য নেই, সম্মান নেই।
১০. শিশু শ্রমিক ও পথশিশু – পড়ার কথা যাদের, তারা ছুটছে পেটের দায়ে।
১১. প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠী – প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক সহায়তার অভাবে নিঃস্ব।
১২. বিচ্ছিন্ন দ্বীপ ও চরাঞ্চলের বাসিন্দা – যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতায় শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও কর্মসংস্থানে ঘাটতি।
১৩. উপকূলীয় জলবায়ু উদ্বাস্তু – ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, লবণাক্ততার শিকার বাস্তুচ্যুত মানুষ।
১৪. অবিবাহিত গর্ভবতী নারী ও ধর্ষণ-নির্যাতনের শিকার নারী – সামাজিক লাঞ্ছনার ভয়ে আত্মগোপনে থাকেন।
১৫. বিশেষ অপরাধে কারাভোগ করে ফিরে আসা মানুষ – সমাজে পুনর্বাসনের সুযোগ না পাওয়ায় পুনরায় অপরাধের পথে ফিরে যান।
কেন তারা অবহেলিত?
রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব: এই জনগোষ্ঠী ভোট দিলেও তাদের কণ্ঠস্বর রাজনৈতিক প্রাধান্য পায় না।
শিক্ষা ও সচেতনতার সীমাবদ্ধতা: অধিকাংশই জানেন না কীভাবে অধিকার আদায় করতে হয়।
সাংগঠনিক শক্তির দুর্বলতা: সংগঠিত হতে না পারায় নীতিনির্ধারণে তাদের প্রভাব পড়ে না।
বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কার: বহু গোষ্ঠীকে এখনো ‘নিচু’ কিংবা ‘অশুচি’ ভাবা হয়।
মিডিয়া ও মূলধারার আলোচনায় অনুপস্থিতি: তাদের গল্পগুলো নিয়ে তেমন কেউ লেখে না, শোনে না।
পরিশেষে একটি সত্যিকারের মানবিক রাষ্ট্রে উন্নয়নের আলো সবার ঘরে পৌঁছানো জরুরি। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে উন্নয়নের আলো প্রায়ই শহরের বিলবোর্ডে ঝলমল করে, আর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ঘরে থাকে অন্ধকার।আমাদের মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র কেবল রাজধানীর নয়; রাষ্ট্র হলো পাহাড়, সমতল, নদী, চর, হাওর, বেদেপল্লি, বস্তি আর হিজড়া সম্প্রদায়েরও। এই সব মানুষদের জীবনের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না করে আমরা কোন উন্নয়নের কথা বলি? মানবিক বিবেচনায়, নৈতিক দায়িত্বে এবং বাস্তব উন্নয়নের লক্ষ্যে—প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কণ্ঠস্বর শুনতে হবে। তাদের অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে। তাহলেই গড়ে উঠবে অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক বাংলাদেশ।
(ইকবাল জিল্লুল মজিদ,পরিচালক – কমিউনিটি হেলথ প্রোগ্রাম, রাডডা এমসিএইচ এফপি সেন্টার)
সংগ্রহ – আমির হোসেন