পেন্টেট ঔষধ এবং হোমিওপ্যাথি, হোমিওপ্যাথির অর্গাননের পরিপন্থী ব্যবহারের বিপদ:
বর্তমান সময়ে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার নানা প্রয়োগ ও বিকাশ ঘটছে, তবে একটি গুরুতর বিষয় যে, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির নামে পেন্টেট ঔষধ বাজারে ছড়িয়ে পড়ছে। হোমিওপ্যাথি একটি সুনির্দিষ্ট দর্শন ও নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে রোগের চিকিৎসায় একক, স্বতন্ত্র ঔষধ ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া হয়। কিন্তু, পেন্টেট ঔষধের প্রয়োগ হোমিওপ্যাথির মূল ধারণার পরিপন্থী, এবং এর ব্যাপক ব্যবহারে চিকিৎসক সমাজের মধ্যে ভুল বার্তা ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। তাই, এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে সতর্কবার্তা প্রদান করা অত্যন্ত জরুরি।
হোমিওপ্যাথি, একক ঔষধের দর্শন: হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির মূল ধারণা হচ্ছে “অ্যাকশন ফর অ্যাকশন”—অর্থাৎ, একই ধরনের উপসর্গ সৃষ্টি করার জন্য ঔষধ প্রয়োগ করা। এটি একক ঔষধের ভিত্তিতে কাজ করে, যেখানে একজন রোগীর শারীরিক, মানসিক এবং আবেগিক অবস্থা পর্যালোচনা করে, তার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত এবং উপকারী ঔষধ নির্বাচন করা হয়। এই পদ্ধতিতে প্রতিটি রোগীকে আলাদা ভাবে বিবেচনা করা হয় এবং চিকিৎসা দেওয়া হয়। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় ঔষধের মাত্রা অত্যন্ত ক্ষুদ্র, যা শরীরের নিজস্ব শক্তিকে উদ্দীপ্ত করে, রোগের মূল কারণের বিরুদ্ধে কাজ করতে সহায়তা করে। হোমিওপ্যাথির প্রতিষ্ঠাতা স্যামুয়েল হানিম্যানের অর্গানন অব মেডিসিন গ্রন্থে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, “একক ঔষধ, একক সময়ে, একক লক্ষণে ব্যবহার করতে হবে”। এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকরা রোগীর সুস্থতার জন্য একক ঔষধের প্রভাব এবং তার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সম্পর্কে সতর্ক থাকে।
পেন্টেট ঔষধ: হোমিওপ্যাথির মৌলিক নীতির পরিপন্থী
পেন্টেট ঔষধ বলতে সাধারণত এমন ঔষধগুলো বোঝানো হয় যা আধুনিক চিকিৎসার ঔষধ প্রযুক্তির সঙ্গে মিল রেখে তৈরি হয় এবং এই ঔষধগুলো একাধিক উপাদান বা মিশ্রণ নিয়ে প্রস্তুত করা হয়। এর মধ্যে ব্যবহৃত রাসায়নিক উপাদানগুলো প্রচলিত হোমিওপ্যাথিক ঔষধের তুলনায় শক্তিশালী এবং ব্যাপকভাবে শরীরের উপর প্রভাব ফেলে। পেন্টেট ঔষধ সাধারণত একাধিক কার্যকরী উপাদান নিয়ে তৈরি হয়, যা একে একে রোগের উপসর্গ দূর করার চেষ্টা করে। কিন্তু এই ধরনের ঔষধ, হোমিওপ্যাথির মূল দর্শন অনুযায়ী, একক ঔষধের ব্যবহারের পক্ষে নয়।
হোমিওপ্যাথিতে পেন্টেট ঔষধ ব্যবহারের ধারণা মূলত একে অপরের বিপরীত, কারণ এটি শরীরের উপর শক্তিশালী প্রভাব ফেলতে পারে, যা হানিম্যানের প্রাকৃতিক ও ক্ষুদ্রমাত্রার চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে সাংঘর্ষিক। এটি রোগীর শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতার সাথে পরিপন্থী হতে পারে এবং শরীরের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
পেন্টেট ঔষধ ব্যবহারের প্রভাব: ভুল বার্তা সমাজে
যদি গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত পেন্টেট ঔষধের ব্যবহার বাড়ে, তবে চিকিৎসক সমাজ এবং সাধারণ জনগণের মধ্যে হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে ভুল ধারণা সৃষ্টি হতে পারে। বিশেষ করে, যারা হোমিওপ্যাথির বিষয়ে অজ্ঞ, তারা এই পেন্টেট ঔষধকে সঠিক হোমিওপ্যাথি হিসেবে গ্রহণ করতে পারে, যার ফলে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরি হবে। অনেকেই মনে করতে পারে, হোমিওপ্যাথি ঔষধ এমনকি আধুনিক চিকিৎসার মতো শক্তিশালী ঔষধের মতো কার্যকরী।
অথচ, হোমিওপ্যাথি মূলত শরীরের স্বাভাবিক প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চায়, যা শক্তিশালী রাসায়নিক উপাদান বা পেন্টেটের সাহায্যে সম্ভব নয়। এটি রোগীর স্বাভাবিক অবস্থাকে বিঘ্নিত করে এবং পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। এই কারণে, সাধারণ জনগণ এবং চিকিৎসকরা হোমিওপ্যাথি এবং আধুনিক চিকিৎসার মধ্যে পার্থক্য না বুঝে ভুল পথে যেতে পারে।
হোমিওপ্যাথি অর্গাননের ভিত্তিতে পেন্টেট ব্যবহারের বিপদ:
হোমিওপ্যাথি অর্গানন অনুসারে, রোগের সঠিক চিকিৎসা একক ঔষধের মাধ্যমে এবং অত্যন্ত সূক্ষ্ম মাত্রায় হতে হবে। এই দর্শন অনুসরণ না করলে, চিকিৎসার ফলাফল বিপরীত হতে পারে। পেন্টেট ঔষধ ব্যবহার রোগীর শরীরে অতিরিক্ত রাসায়নিক উপাদান প্রবাহিত করতে পারে, যা হোমিওপ্যাথির মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুতি ঘটায়। এছাড়া, পেন্টেট ঔষধ ব্যবহারের ফলে রোগীকে অতিরিক্ত চিকিৎসা, মিশ্রণ বা উপাদানের সমন্বয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে, যা তাদের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। হোমিওপ্যাথির মূল লক্ষ্য হল রোগীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের সামগ্রিক উন্নতি, যা পেন্টেট ঔষধের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব নয়।
সুতরাং পেন্টেট ঔষধ হোমিওপ্যাথির মৌলিক নীতির পরিপন্থী এবং এর ব্যবহারে রোগী ও চিকিৎসক সমাজে ভুল বার্তা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় একক ঔষধের ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক সমাধান সঠিক পথ, যা রোগীর দীর্ঘস্থায়ী সুস্থতা নিশ্চিত করে। তাই, পেন্টেট ঔষধ ব্যবহারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসকদের উচিত সতর্কতা অবলম্বন করা এবং সমাজে সঠিক বার্তা পৌঁছানো। রোগীর চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথির অর্গাননের নির্দেশিকা অনুসরণ করে, একক ঔষধের মাধ্যমে সর্বোত্তম ফল পাওয়া সম্ভব।
ইকবাল জিল্লুল মজিদ
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক
পরিচালক, কমিউনিটি হেলথ, রাড্ডা এমসিএইচ-এফপি সেন্টার
সংগৃহীত