বাংলাদেশের সমাজে কাজিয়া
রম্য রচনা / ইকবাল জিল্লুল মজিদ
বাংলাদেশে জন্ম নিলে আপনার জন্মসুত্রেই কিছু অধিকার মিলে যায়। যেমন—ইচ্ছা মতো খেতে না পারার অধিকার, যানজটে বসে জীবনের অর্থ খোঁজার অধিকার, আর অবশ্যই, কাজিয়ায় জড়িয়ে পড়ার জন্মগত অধিকার! আমাদের সমাজে ‘কাজিয়া’ এখন এমন এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে, যার স্বীকৃতি দিতে ইউনেস্কো পর্যন্ত ভাবছে—“ইহা কি বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করিব?”
রাজনীতি: “আমার দল বড়, তোমার দল গরু!”
রাজনীতি এখন আর তত্ত্ব নয়, চিরস্থায়ী কাজিয়ার জমজমাট মঞ্চ। দুই দল মানে দুই দঙ্গল! যার মূলমন্ত্র—“তুই ভুল, আমি ঠিক!” এমপি সাহেব নন, কাউন্সিলরও নন—এমনকি দলের নতুন সদস্যও একবার দলে ঢুকেই চেঁচান, “এই দল ছাড়া দেশ চলবে না!” এরপরে অন্য পক্ষ বলে, “চলো দেশ বাঁচাও!” এক কাজিয়ার উপর আরেক কাজিয়া, যেন ‘কাজিয়া ইনসাইড কাজিয়া’। রাজনীতিতে কাজিয়া না হলে লোকজন ভাবে, “নাকি সরকার পড়ে গেছে?”
পাড়া-মহল্লায়: কাজিয়ার গন্ধে শুঁয়োরও পালায়!
তৃণমূল বলতে আমরা এখন বোঝি, তর্কের মূল। ফুটপাতের দোকানি আর হকারের কাজিয়া চলতে থাকে সকাল থেকে রাত। “তুই এক ইঞ্চি জায়গা বাড়িয়ে বসছিস”—এই কথাতেই শুরু, শেষ হয় পুলিশ ডেকে এনে মিলেমিশে চা খাওয়ার মাধ্যমে। সবার মুখে এক কথা, “আমার দোকান সরকারি অনুমোদিত”। অথচ পাশে লেখা—‘দোকান ভাঙার আগে এক কাপ চা খেয়ে যেও!’
অফিস-আদালতে: ফাইল নয়, মুখ চলুক!
ঘুসখোর অফিসার আর সেবাপ্রার্থী জনগণের কাজিয়া শুনলে, ‘নাট্যকলা বিভাগ’ও চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে বসে! ফাইল পড়ে ধুলা খায়, কিন্তু কণ্ঠে বজ্রনিনাদ:
— “আপনার ফাইল তো ৩ নাম্বার টেবিলে।”
— “কিন্তু ভাই, ৩ নাম্বার টেবিল বলছে ৫ নাম্বারে।”
— “ওটা তো ডুপ্লিকেট ফাইল, আসলটা আমি খুঁজে পাইনি। আপনার কিছু খোঁজ আছে?”
তবে শেষমেশ এক ‘ফাইভ হান্ড্রেড টাকিয়া’ দানেই সমস্ত কাজিয়া থেমে যায়। সবাই বলে—“দেখলেন তো? এইটাই বাংলাদেশ!”
পারিবারিক কাজিয়া: সোশ্যাল মিডিয়ার শ্রেষ্ঠ উপাদান
স্বামী-স্ত্রীর কাজিয়া এমন এক থ্রিলার, যেখানে প্রতিদিন নতুন এপিসোড! প্রথম দিন স্ত্রীর অভিযোগ—”তুমি আমার বান্ধবীর ছবিতে লাভ রিঅ্যাক্ট দিছো কেন?”
তৃতীয় দিন স্বামী চেঁচায়—”তোমার মা আমাদের সংসারে হস্তক্ষেপ করেন কেন?”
পঞ্চম দিন শাশুড়ির প্রবেশ, ষষ্ঠ দিন শশুরের ‘মতামত’…
এভাবে চলে দীর্ঘ ধারাবাহিক, যার শেষে দাম্পত্য জীবন আর সিরিয়ালের পার্থক্য কেউ বোঝে না!
রাস্তাঘাটে কাজিয়া: ট্রাফিক সিগন্যাল না, তর্ক সিগন্যাল!
একটি রিকশা আর একটি সিএনজির মাঝখানে ধাক্কা লাগলে শুরু হয় মহাকাব্য।
— “তুই উল্টোপথে আইসসোস!”
— “তোর বাপের রাস্তা নাকি?”
এরমধ্যে এক পথচারী বলে বসে, “চাচা, আপনার ব্রেক ঠিক ছিল?”
তখন দুই পক্ষ একত্রিত হয়ে নতুন কাজিয়া শুরু করে, “এই পথচারীর জন্মের শুদ্ধতা যাচাই করো!”
ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, ক্রীড়াক্ষেত্রে: “আমার পীর বড়, না তোর কোচ?”
মাজারে মাজারে কাজিয়া চলে—কে বেশি অলৌকিক, কার ভক্ত বেশি। আবার দুই ফুটবল দলের সমর্থক রাস্তায় নেমে একে অন্যকে বলে—“তুই বেলজিয়ামের সাপোর্ট করিস কেন?” এই প্রশ্নে তর্ক, তর্কে ধাক্কাধাক্কি, শেষে আরামে ডাব খেয়ে শান্তি চুক্তি।
পরিশেষে: কাজিয়া—জাতীয় ঐতিহ্য?
বাংলাদেশে জন্ম নেওয়ার অর্থ, কমপক্ষে মাসে একবার কোন না কোন কাজিয়ায় নিজেকে জড়ানো। হয় নিজে তর্ক করবেন, নয়তো দুজনের তর্কে নিরপেক্ষ “বিচারক” হবেন। তাই প্রস্তাব করছি—আগামী বছরের আন্তর্জাতিক মেলার থিম হোক:
“বাংলাদেশ: Land of Logical লড়াই”
আর জাতীয় খেলা ঘোষণা করা হোক—কাজিয়া!
কাজিয়া আমাদের একতা, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের জাতীয় পরিচয়। কে বলেছে বাংলাদেশে কিছু হয় না?
আমরা তর্কে উন্নত, চেঁচামেচিতে দক্ষ, আর কাজিয়ায় অভিজ্ঞ! আর কী লাগে, ভাই? জয় হোক কাজিয়ার!