বাংলাদেশ: যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ—জাতীয় নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ
পোশাক শিল্পে শুধু নয়, বাংলাদেশী পণ্যের রফতানিতেও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ এবং একইসাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য, নিষেধাজ্ঞা ও কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের বিষয়টি শুধু অর্থনৈতিক নয়, এটি একটি গভীর কূটনৈতিক ও নিরাপত্তা বিষয়ক ইস্যুতে রূপ নিচ্ছে। এটি আমাদের জাতীয় নিরাপত্তা, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও আর্থ-রাজনৈতিক ভারসাম্যের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশকে প্রয়োজন আত্মবিশ্বাস, কৌশলী কূটনীতি এবং দৃঢ় অবস্থান।
অর্থনৈতিক চাপ: শুধু পোশাক শিল্প নয়, সামগ্রিক রফতানি হুমকির মুখে?
বাংলাদেশের রফতানি আয়ের বড় অংশ আসে তৈরি পোশাক (RMG) খাত থেকে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অন্যান্য খাত যেমন কৃষিপণ্য, চামড়া, হস্তশিল্প, পাটজাত দ্রব্য, হোম টেক্সটাইল, আইটি সার্ভিস, এমনকি ওষুধ শিল্পও ধীরে ধীরে বৈদেশিক বাজারে অবস্থান তৈরি করছে। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ বা বাণিজ্যিক সুবিধা হ্রাস করার হুমকি কেবল গার্মেন্টস শিল্প নয়, বাংলাদেশি পণ্যের সামগ্রিক রফতানি প্রবাহকেই বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
অবশ্য, যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশকে জিএসপি সুবিধা থেকে বঞ্চিত রেখেছে। এখন আবার শুল্ক আরোপের হুমকি এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে চাপ প্রয়োগ—এগুলো একসাথে বিবেচনা করলে বোঝা যায়, এটি কেবল বাণিজ্যিক নয়, বরং রাজনৈতিক চাপেরও প্রতিফলন।
অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ: জাতীয় নিরাপত্তার ওপর আঘাত
যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা “মানবাধিকার” বা “গণতন্ত্র রক্ষার” অজুহাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, নির্বাচন পদ্ধতি, প্রশাসনিক কাঠামো ইত্যাদি নিয়ে প্রকাশ্যে বক্তব্য দেওয়া এবং নিষেধাজ্ঞার হুমকি আসলে একটি স্বাধীন দেশের সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ। কোনো দেশের রাজনৈতিক কাঠামো কীভাবে চলবে, তা সে দেশের জনগণ এবং সংবিধানই নির্ধারণ করে।
বিশ্বের ইতিহাস বলছে—যেসব দেশে যুক্তরাষ্ট্র “গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার” কিংবা “মানবাধিকারের রক্ষক” হতে চেয়েছে, সেসব দেশে দীর্ঘস্থায়ী বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের মতো স্থিতিশীল ও উন্নয়নমুখী রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে হস্তক্ষেপ জাতীয় নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে
বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব: দরকষাকষির শক্ত ভিত
বাংলাদেশ এখন আর আগের অবস্থানে নেই। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জনসংখ্যাগত সুবিধা, শ্রমনির্ভর উৎপাদন ব্যবস্থা এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক কাঠামো বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার একটি কৌশলগত হাবে পরিণত করেছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে এর ভৌগোলিক অবস্থান, চীন-ভারত-মার্কিন দ্বন্দ্বে বাংলাদেশের অবস্থানকে দিয়েছে আলাদা গুরুত্ব।
যুক্তরাষ্ট্র চাইলেও বাংলাদেশকে এড়িয়ে যেতে পারবে না। এটি আমাদের দরকষাকষির বড় ভিত্তি। বাংলাদেশকে এখনই বিকল্প বাজার যেমন—ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, রাশিয়া, তুরস্ক, দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সম্পর্ক জোরদার করতে হবে।
ইতিহাস বলছে, বাংলাদেশ সংকটে পথ খুঁজে নেয়
বাংলাদেশের ইতিহাস লড়াইয়ের, প্রত্যাখ্যানের এবং পুনর্জাগরণের ইতিহাস। ১৯৯০-এর দশকের রাজনৈতিক সংকট, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দা, ২০১৩-১৪ সালের রাজনৈতিক সহিংসতা, ২০২০ সালের কোভিড-১৯ মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে জ্বালানি সংকট—সবই বাংলাদেশকে একাধিকবার বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছিল। তবুও, বাংলাদেশ ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে তৈরি পোশাক রফতানিতে বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম। অন্যদিকে, ওষুধ, চামড়া, হোম ডেকর, পাট, আইটি ও কৃষিপণ্যেও রফতানি বাড়ছে। কাজেই এক মার্কেটের ওপর নির্ভর না করে, বহুমুখীকরণ এবং অভ্যন্তরীণ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।
স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি ও আত্মমর্যাদার রক্ষায় স্পষ্ট বার্তা দরকার
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি সবসময় ছিল “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়”—এই নীতিতে বিশ্বাসী। কিন্তু বন্ধুত্ব একতরফাভাবে চাপের মাধ্যমে চলে না। পারস্পরিক সম্মান ও আস্থার ভিত্তিতে সম্পর্ক টিকে থাকে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ বা মানবাধিকার নিয়ে বারবার প্রকাশ্য চাপ প্রয়োগ আমাদের আত্মমর্যাদা ও নীতিগত অবস্থানকে ক্ষুন্ন করে।
এই পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত হবে কূটনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝানো যে, চাপের মাধ্যমে কিছু অর্জন সম্ভব নয়। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, যেখানে জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে কীভাবে দেশ চলবে।
উপসংহার: সংকটে সাহস ও কৌশলের বিকল্প নেই
আজকের বিশ্ব বাস্তবতায় ছোট দেশগুলোকেও বড় রাজনৈতিক খেলায় প্যাদানি খেতে হয়—যদি তারা আত্মবিশ্বাস, দক্ষ কূটনীতি ও বিকল্প প্রস্তুতি না রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ বা অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ অবশ্যই আমাদের জন্য একটি সতর্ক সংকেত। তবে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশ অতীতেও একাধিক সংকট মোকাবেলা করে আজকের অবস্থানে এসেছে।
আমাদের করণীয় হলো—
১. ভবিষ্যতমুখী বাণিজ্য কৌশল গ্রহণ,
২. বহুমুখী রফতানি বাজার তৈরি,
৩. আত্মমর্যাদাপূর্ণ ও কৌশলগত পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়ন, এবং
৪. জাতীয় ঐক্য ও আস্থা বজায় রাখা।ক
বাংলাদেশ কারও করুণা নয়, বরং নিজের শ্রম, মেধা ও আত্মত্যাগের ফসল। এই আত্মবিশ্বাসেই আগামীর পথে এগিয়ে যেতে হবে—সাহসের সঙ্গে, দৃঢ়তায়।
ইকবাল জিল্লুল মজিদ, চিন্তাবিদ