সুশাসন অনেক কঠিন:বিগত শাসনামলে ব্যাংক খাত ধ্বংসের নির্মম চিত্র
ইকবাল জিল্লুল মজিদ
ভূমিকা
সুশাসনের অভাব রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে দুর্বল করে তোলে। বিশেষত, ব্যাংকিং খাতে যখন রাজনৈতিক প্রভাব, জবাবদিহির ঘাটতি, এবং লুটপাটের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পায়, তখন পুরো রাষ্ট্রই আর্থিকভাবে ঝুঁকিতে পড়ে।বিগত সরকারের দেড় দশকের শাসনকালে এ বাস্তবতা আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।বিগত সরকার একাধিকবার “দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স” নীতি ঘোষণা করলেও বাস্তবে পিকে হালদার, বেসিক ব্যাংক, হলমার্ক, এনআরবি গ্লোবাল, এবং সর্বশেষ এস আলম গ্রুপের মত প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোর সীমাহীন লুটপাট জনগণের চোখে এক নির্মম প্রতারণা।
ব্যাংক খাত ধ্বংসের বড় উদাহরণসমূহ
১. পিকে হালদার: আর্থিক খাতের কুখ্যাত ডাকাত
বিগত সরকারের শাসনকালেই রিলায়েন্স ফাইন্যান্স, পিপলস লিজিং, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং–এ কর্মরত পিকে হালদার কাগুজে কোম্পানির মাধ্যমে ৩,৫০০ কোটি টাকারও বেশি আত্মসাৎ করেন। তিনি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা তুলে নেন এবং তা পাচার করে কানাডা ও ভারতে অবৈধ সাম্রাজ্য গড়েন। ২০১৯ সালে দেশ ছাড়ার পর ২০২২ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ধরা পড়লেও তার টাকা পুনরুদ্ধার হয়নি, বিচারও অনিশ্চিত।
২. বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি
২০১০-১৩ সালে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক থেকে প্রায় ৪,৫০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি হয়। তৎকালীন চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চু ও তার ঘনিষ্ঠরা ঋণ অনুমোদনের নামে রাষ্ট্রীয় টাকা লোপাট করেন। বিস্ময়করভাবে—দুদক এই কেলেঙ্কারির তদন্তে তাকে অভিযুক্ত করতে বিলম্ব করে। অভিযোগ রয়েছে, তার পেছনেও ছিল রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের অদৃশ্য হাত।
৩. হলমার্ক দুর্নীতি
২০০৯-২০১৪ সময়কালে সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপের নামে ৩,৫০০ কোটি টাকা লোপাট হয়। তদন্তের মুখে পড়লেও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা ও বিচার ব্যবস্থার ধীরগতির কারণে অপরাধীদের অনেকেই এখনও শাস্তি পায়নি।
৪. এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক কেলেঙ্কারি
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা এমবি ইসলাম (পাবেল) ব্যাংক ব্যবস্থার দুর্বলতা ও রাজনৈতিক সংযোগ ব্যবহার করে কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম ভঙ্গ করে বিদেশে অর্থ প্রেরণ এবং ব্যক্তিগত স্বার্থে ব্যাংক ব্যবহার করেন তিনি, যার প্রমাণ মিলেছে দেশের তদন্ত সংস্থার হাতে।
৫. এস আলম গ্রুপ: “অনুমোদিত ঋণের বাইরে ৩০ হাজার কোটি টাকা!”
২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে একটি আন্তর্জাতিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে প্রকাশ পায়, চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপ প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি অননুমোদিত ঋণ নিয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংক থেকে, যার মধ্যে সোনালী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক উল্লেখযোগ্য।
অভিযোগ অনুযায়ী—
এস আলম গ্রুপ নিজেদের মালিকানাধীন ব্যাংক (শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক) থেকে নৈতিকতা ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে ঋণ নিয়েছে।
টাকা বিদেশে বিনিয়োগ করা হয়েছে—মালয়েশিয়া, দুবাই ও কানাডায় বিভিন্ন রিয়েল এস্টেট প্রকল্পে।
বাংলাদেশ ব্যাংক তাদের অডিট রিপোর্টে ঋণ অনিয়ম চিহ্নিত করলেও তা গোপন রাখা হয়।
এস আলম গ্রুপের মালিক সালাম মুরশেদীর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সংযোগ, বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ পর্যায়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণেই ব্যাংক ও সরকারি সংস্থাগুলো নীরব থাকে।
এই ঘটনা প্রমাণ করে, একটি গ্রুপ যখন ব্যাংক, মিডিয়া, শিল্প, এবং রাজনীতি—সবকিছুকে কব্জা করে, তখন রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুট হয়ে যায় অনুমতি ছাড়াই।
ব্যাংকিং খাতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ফলাফল
ঋণ খেলাপি ক্রমাগত বাড়ছে—বর্তমানে প্রায় ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক কার্যত স্বাধীন নয়—নিয়োগ, নীতিমালা ও তদন্তে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ রয়েছে।
দুর্নীতির বিচার নেই—দুদক ও অন্যান্য সংস্থা চুপ থাকে ক্ষমতাসীনদের ঘনিষ্ঠদের ব্যাপারে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভাবমূর্তির অবনমন
ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (FATF) বাংলাদেশকে মনিটরিং তালিকায় রাখার হুমকি দিয়েছে অর্থ পাচার ও দুর্বল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার কারণে।
বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বারবার ব্যাংক সংস্কার ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বলেছে, শর্ত দিয়েছে ঋণের বিপরীতে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীরা ব্যাংকিং খাত থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
“জিরো টলারেন্স” কথায় নয়, কাজে প্রমাণ দরকার
সরকারের “জিরো টলারেন্স” নীতি বারবার ঘোষিত হলেও বাস্তবে পিকে হালদার, বেসিক ব্যাংক, হলমার্ক কিংবা এস আলমের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা আজও গ্রহণ করা হয়নি।
আসলে দুর্নীতিবাজদের বেশিরভাগই শাসকদলের ঘনিষ্ঠ—ফলে আইনের শাসন এখানে প্রশ্নবিদ্ধ।
করণীয়
১. বাংলাদেশ ব্যাংকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
২. দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ীদের বিদেশে পাচারকৃত সম্পদ ফিরিয়ে আনা এবং দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
৩. রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে রাজনৈতিক নিয়োগ বন্ধ করে পেশাদারিত্ব ফিরিয়ে আনতে হবে।
৪. ঋণ খেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
৫. নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে যেন দুর্নীতি সহজে উদঘাটিত হয়।
উপসংহার
সুশাসন কোনো জাদু নয়—এটি পরিকল্পনা, সদিচ্ছা এবং দায়বদ্ধতার বাস্তব প্রয়োগ। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে যে অরাজকতা, লুটপাট এবং অনিয়ন্ত্রিত ক্ষমতার চর্চা ঘটেছে, তা বিগত সরকারের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ ও স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ করে।
পিকে হালদার, বেসিক ব্যাংক, হলমার্ক, এনআরবি গ্লোবাল, এবং এস আলম গ্রুপ—এইসব নাম শুধু আর্থিক কেলেঙ্কারির নয়, সুশাসনের অন্তর্জলি যাত্রার প্রতীক।
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে হলে এখনই সময় সৎ সাহস নিয়ে দুর্নীতির শিকড় উপড়ে ফেলার।
তথ্যসূত্র:
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিবেদন, ২০২১–২০২৪
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (TIB)
The Daily Star, Prothom Alo, Al Jazeera, New Age
বাংলাদেশ ব্যাংক বার্ষিক প্রতিবেদন ও অভ্যন্তরীণ পরিদর্শন রিপোর্ট