ম্যানগ্রোভের মায়াবী অরণ্যে বাঘের গর্জন বাড়ছে, বিশ্ব বাঘ দিবসে সুন্দরবনের ইতিবাচক বার্তা
🖊️ হাসান মাহমুদ
বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে আবারো প্রাণ ফিরছে বনের রাজা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের গর্জনে। নানা সংকট পেরিয়ে একসময়ে যেখান থেকে আশঙ্কাজনকভাবে হারিয়ে যাচ্ছিল এই মহাবিপন্ন প্রাণীটি, সেখানে এখন দেখা মিলছে নতুন আশার আলো। বন বিভাগের সর্বশেষ ক্যামেরা ট্র্যাপ জরিপ অনুযায়ী, ২০২৪ সালে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২৫টিতে, যা ২০২২ সালের ১১৪টি থেকে ১১টি বেশি।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বাঘ সংরক্ষণে বিগত কয়েক বছরে নেওয়া নানামুখী পদক্ষেপেই এসেছে এ ইতিবাচক পরিবর্তন। সুন্দরবনের পশ্চিম বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এজেডএম হাছানুর রহমান জানান, “বাঘের নিরাপদ আবাস নিশ্চিত করতে চোরা শিকার প্রতিরোধ, বন প্রহরীদের কার্যক্রম জোরদারকরণ এবং জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম চালানো হয়েছে। এরই ফলশ্রুতিতে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে।”
বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে লোকালয়ে চলে আসা বাঘকে আগের মতো পিটিয়ে মারা হচ্ছে না। স্থানীয় জনগণ এখন সচেতন—বাঘও এই বনভূমির অংশ। পিপলস ফোরামের সভাপতি মোল্যা মনিরুজ্জামান জানান, “সাম্প্রতিক সময়ে লোকালয়ে বাঘ এলে বনবিভাগকে জানানো হয়। মানুষ বাঘ পিটিয়ে না মেরে নিরাপদে বন এলাকায় ফেরত পাঠাতে সহায়তা করছে।”
জেলে-বাওয়ালীদের মতে, বনে বাঘের চলাফেরা আগের চেয়ে অনেক বেশি দেখা যাচ্ছে। শাবকসহ বাঘের উপস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণে আসছে, যা প্রাকৃতিকভাবে বাঘের বংশবৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।
স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩৫০টি। পরবর্তী দশকে তা ৪৩০-৪৫০ পর্যন্ত গিয়েছিল। তবে ২০১৫ সালে এক গবেষণায় দেখা যায়, বাঘের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০৬টিতে—যা সারা বিশ্বে তোলপাড় ফেলে দেয়। এরপর থেকে বাঘ সংরক্ষণে সরকার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতায় ব্যাপক কার্যক্রম শুরু হয়।
২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে সুন্দরবনে মারা গেছে ৫০টি বাঘ, যার মধ্যে ২৫টি চোরা শিকারিদের হাতে, ১৪টি মারা গেছে স্থানীয়দের হাতে, আর মাত্র ১০টি স্বাভাবিকভাবে। ২০০৭ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’-এ মারা যায় একটি বাঘ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সুন্দরবন হলো এশিয়ায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের অন্যতম বড় আবাসভূমি। তবে একে পুরোপুরি নিরাপদ করে তুলতে না পারলে বাঘের দীর্ঘমেয়াদী বেঁচে থাকা নিশ্চিত করা কঠিন হবে। বাঘের প্রাকৃতিক আবাসভূমিকে নিরাপদ রাখতে আরো কৌশলী পদক্ষেপ দরকার।
প্রতি বছর ২৯ জুলাই পালিত হয় বিশ্ব বাঘ দিবস। এই দিনে বাঘ সংরক্ষণের বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয় বিশ্বব্যাপী। বাংলাদেশের জন্য এ দিবসটি আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে সুন্দরবনের সাফল্যগাথা সামনে আসায়। এখন দরকার এ অর্জন ধরে রাখা এবং আগামী দিনে বাঘের গর্জনে আবার মুখরিত করা সুন্দরবনের প্রতিটি প্রান্ত।