বাংলার ইতিহাসে এক অনন্য উপাখ্যান— গাজী, কালু ও মায়ি চম্পা
✍️ হাসান মাহমুদ
বাংলার জনপদে ছড়িয়ে থাকা লোককাহিনিগুলো আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও সমাজচিন্তার অপরিহার্য অংশ। এইসব কাহিনির মধ্যে গাজী-কালু-চম্পাবতী উপাখ্যান এক স্বতন্ত্র অবস্থান দখল করে আছে। ধর্মীয় বিশ্বাস, প্রেম, যুদ্ধ, আত্মত্যাগ ও আধ্যাত্মিক সাধনার অনুপম সমন্বয়ে গঠিত এই উপাখ্যান শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সাধারণ মানুষের মুখে-মুখে, কীর্তনে, পুঁথিপাঠে ও দরগাহর আঙিনায় বেঁচে আছে।
ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী, গাজীর প্রকৃত নাম বড়খান গাজী। তিনি ছিলেন প্রভাবশালী শাসক জাফর খান গাজীর পুত্র। পিতা ত্রিবেণী ও সপ্তগ্রাম অঞ্চলের মুসলিম শাসক হিসেবে ইসলাম প্রচার এবং হিন্দু রাজাদের বিরুদ্ধে একাধিক যুদ্ধ পরিচালনা করেন। বড়খান গাজী নিজেও সেই উত্তরাধিকার বহন করেন। তবে রাজনীতি ও শাসন তাকে টানতে পারেনি। শৈশব থেকেই ফকির দরবেশদের সাহচর্যে এসে গাজী হয়ে ওঠেন আধ্যাত্মিক সাধক। কিন্তু ধর্ম প্রচার ও মুসলিম জনমানস গঠনের দায়িত্ব তিনি পালন করেন দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে। দক্ষিণ বাংলার যশোর-খুলনা অঞ্চলে গাজীর তৎপরতা মূলত ব্রাহ্মণ জমিদার মুকুট রায়-এর বিরোধিতার প্রেক্ষাপটে চূড়ান্ত রূপ নেয়। মুকুট রায় ছিলেন ইসলামবিরোধী কট্টরপন্থী শাসক, যিনি মুসলমানদের সঙ্গে মেলামেশা তো দূরের কথা, দর্শন করলেও তৎক্ষণাৎ শুদ্ধিকরণ প্রথা অনুসরণ করতেন। গাজী তার অনুসারী কালুকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে মুকুট রায়ের দরবারে পাঠালে তাকে বন্দী করা হয়। এর জবাবে ১৩৬৫ খ্রিস্টাব্দে খানিয়ার ময়দানে গাজী বাহিনীর সঙ্গে মুকুট রায়ের যুদ্ধ হয়। ইতিহাস জানায়, গাজী বিজয়ী হন এবং আত্মসম্মান রক্ষায় মুকুট রায় কূপে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেন। মুকুট রায়ের একমাত্র কন্যা চম্পাবতী বা সুভদ্রা ছিলেন অতি রূপসী এবং গুণবতী। যুদ্ধশেষে তিনি গাজীর হাতে বন্দী হন। পরবর্তী সময়ে গাজীর সঙ্গেই তার বিয়ে হয়। তবে তাদের দাম্পত্যজীবন দীর্ঘস্থায়ী ছিল না বলেই অনেক ঐতিহাসিকের মত। গাজীর সংসারবিরাগ ও আধ্যাত্মিক প্রবণতার সঙ্গে রাজকন্যার জীবন সম্ভবত খাপ খায়নি। চম্পাবতী শেষ জীবন অতিবাহিত করেন সাতক্ষীরা অঞ্চলের লাবসা গ্রামে, যেখানে তিনি ধর্মসেবা, দান ও আধ্যাত্মিকতায় মনোনিবেশ করেন। স্থানীয় জনগণ তাকে ‘মা-চম্পা’ বা ‘মায়ি চম্পা বিবি’ নামে ডাকত। তার মৃত্যুর পর সেই স্থানেই নির্মিত হয় একটি দরগাহ, যা আজও ‘মায়ি চম্পার দরগা’ নামে পরিচিত। সাতক্ষীরা জেলা সদর থেকে মাত্র ৩ কিলোমিটার দূরে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত লাবসা গ্রামের এই দরগাটি কেবল একটি সমাধিস্থল নয়— এটি এক ঐতিহাসিক নারীর আত্মত্যাগ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও আধ্যাত্মিক জীবনের স্মারক। এখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বহু ভক্ত-অনুসারী শ্রদ্ধা জানাতে আসেন। চম্পাবতী যে শুধুই এক রাজকন্যা ছিলেন, তা নয়—তিনি ছিলেন সময়ের চেয়ে অগ্রসর এক চিন্তাশীল নারী, যিনি তার জীবনের গতিপথ বদলে দিয়ে হয়ে উঠেছিলেন এক আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক। তাই তাকে ঘিরে জনশ্রুতি, ইতিহাস ও লোকবিশ্বাস এক মায়াময় উপাখ্যানে পরিণত হয়েছে।
গাজী, কালু ও চম্পাবতীর গল্প শুধু একটি ধর্মীয় অথবা যুদ্ধভিত্তিক উপাখ্যান নয়; এটি বাংলার ইতিহাসে ধর্মীয় সহাবস্থান, নারীচরিত্রের মহিমা, এবং আধ্যাত্মিক শক্তির প্রভাব তুলে ধরার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। লোকসাহিত্যের শক্তি এখানেই—তথ্য, বিশ্বাস ও কল্পনার সংমিশ্রণে ইতিহাসের পাশাপাশি প্রাণ পায় চেতনায়। সাতক্ষীরার মায়ি চম্পার দরগা যেন সেই চেতনার একটি জীবন্ত স্মারক।