নীরব মহামারি: বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগ—বাস্তবতা, ভয়াবহতা ও সমাধানের রোডম্যাপ
ইকবাল জিল্লুল মজিদ, পরিচালক কমিউনিটি হেলথ প্রোগ্রাম, রাডডা এমসিএইচ এফপি সেনটার, মিরপুর
ভূমিকা
বাংলাদেশে মৃত্যুর প্রধান কারণ এখন অসংক্রামক রোগ (NCD)—হৃদ্রোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার, ক্রনিক শ্বাসতন্ত্রের রোগ ও ডায়াবেটিস। বিশ্বব্যাংক/WHO–র সাম্প্রতিক অনুমানে ২০১৯ সালে দেশের মোট মৃত্যুর প্রায় ৭০%-এর পেছনে NCD দায়ী; WHO–র বাংলাদেশের country story-ও ৬৭% মৃত্যুর কথা দেখায় এবং ৩০–৭০ বছর বয়সে ‘premature’ মৃত্যুঝুঁকি উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ একই সঙ্গে ‘ডাবল বার্ডেন’—সংক্রামক রোগ, মাতৃ-শিশু স্বাস্থ্যচ্যালেঞ্জের পাশাপাশি দ্রুত বাড়তে থাকা NCD—বহন করছে। এ প্রবণতা রোধ না হলে স্বাস্থ্যব্যয়, উৎপাদনশীলতা ও দারিদ্র্যচক্র আরও খারাপ হবে।
বর্তমান অবস্থা: ঝুঁকিকারক ও রোগের বোঝা (ডাটা-চিত্র)
জাতীয় STEPS সমীক্ষা ২০১৮ (১৮–৬৯ বছর):
তামাক ব্যবহার (যেকোনো রূপ): ৪৩.৭%; ধূমপান দৈনিক ২২.৩%; স্মোকলেস ২৬.২%। পুরুষদের মধ্যে ব্যবহার বেশি।
ফল/সবজি অপর্যাপ্ত (<৫ সার্ভিং/দিন): ৮৯.৬%।
শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা (WHO মানদণ্ডে): ২৯.১%।
ওজনাধিক্য ২০.৫%, স্থূলতা ৫.৪%; হাইপারটেনশন ২১.০%; ডায়াবেটিস ৮.৩% (ফাস্টিং গ্লুকোজ ≥৭.০ mmol/L বা ওষুধে).
≥৩টি ঝুঁকিকারক একসাথে: প্রাপ্তবয়স্কদের ২৬.২%।
ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব (IDF ২০২৪): প্রাপ্তবয়স্কদের ১৩.২%; মোট রোগী প্রায় ১.৩৯ কোটি—এ সংখ্যা ২০৫০ সালে ২.৩১ কোটিতে যেতে পারে।
বায়ুদূষণ: ২০২৪ সালের IQAir রিপোর্টে বাংলাদেশ দ্বিতীয় সর্বাধিক দূষিত দেশ; বার্ষিক PM₂.₅ গড় ৭৮ µg/m³—WHO গাইডলাইনের ~১৫ গুণ। বায়ুদূষণজনিত অসংখ্য অকালমৃত্যু ও কার্ডিও-শ্বাসতন্ত্রের রোগ বাড়ছে।
ভয়াবহতার মাত্রা—কেন এখনই পদক্ষেপ প্রয়োজন
১. অর্থনৈতিক চাপ: NCD চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি; প্রাইভেট খরচ বেশি—ক্যাটাস্ট্রফিক ব্যয় ও দারিদ্র্যের ঝুঁকি বাড়ায়।
২. সার্ভিস-রেডিনেস গ্যাপ: প্রাথমিক স্বাস্থ্যব্যবস্থায় (PHC) NCD শনাক্তকরণ, রেফারেল, ওষুধ-সরবরাহে ঘাটতি—যদিও সরকার ‘NCD কর্নার’ চালু করেছে, পূর্ণ সক্ষমতা গড়ে তোলা বাকি।
৩. ঝুঁকিকারকের ক্লাস্টারিং: একাধিক ঝুঁকি একসাথে থাকার হার বেশি—যার মানে একই ব্যক্তির ভবিষ্যৎ স্ট্রোক/হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি দ্রুত বাড়ে।
ইতিমধ্যেই যা হয়েছে (নীতিপ্রেক্ষিত—সংক্ষেপ)
মাল্টিসেক্টরাল অ্যাকশন প্ল্যান (২০১৮–২০২৫): ঝুঁকি কমানো, স্বাস্থ্যপ্রচারণা, সার্ভিস-স্ট্রেন্থেনিং ও সার্ভেইলেন্স—এই চার স্তম্ভে সরকারের রোডম্যাপ বিদ্যমান।
NCD কর্নার (উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্স): ২০১২ থেকে ধাপে ধাপে চালু; ডায়াবেটিস–হাইপারটেনশন ব্যবস্থাপনায় ভূমিকা রাখছে, তবে ব্যবহার/মানোন্নয়নের আরও সুযোগ আছে।
ট্রান্স ফ্যাট নিয়ন্ত্রণ: বাংলাদেশ ফুড সেফটি অথরিটি সর্বোচ্চ ২% TFA সীমা জারি করেছে—আন্তর্জাতিক ‘বেস্ট-প্র্যাকটিস’-সামঞ্জস্যপূর্ণ।
তামাক নিয়ন্ত্রণ: ২০০৫ আইন (২০১৩ সংশোধন) কার্যকর; ২০২৫ সালে ই-সিগারেট আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা যুক্ত হয়েছে; তবে বিস্তৃত সংশোধনী বিল (পয়েন্ট-অফ-সেল ডিসপ্লে/DSA, সিঙ্গেল স্টিক/DSA, ডিএসএ বাতিল ইত্যাদি) এখনো আলোর মুখ দেখেনি।
সরকারের করণীয়—১০টি অগ্রাধিকার (স্বল্প–মাঝারি–দীর্ঘমেয়াদ)
১. প্রাইমারি কেয়ারকে NCD-র জন্য ‘ফার্স্ট রেসপন্ডার’ বানানো
WHO PEN/গাইডলাইন অনুযায়ী স্ক্রীন–ট্রিট–কন্ট্রোল প্রোটোকল, ইলেক্ট্রনিক রেজিস্ট্রি, ওষুধের নিশ্চিত প্রাপ্যতা (থায়াজাইড/ACEi/ARB/CCB, স্ট্যাটিন, মেটফর্মিন/ইনসুলিন ইত্যাদি), ও টাস্ক-শিফটিং।
২. NCD কর্নার স্কেল-আপ ও মানোন্নয়ন
ফ্যাসিলিটি প্রস্তুতি অডিট, HCW ট্রেনিং, গ্লুকোমিটার/লিপিড পরীক্ষা, কেস-ম্যানেজমেন্ট সুপারভিশন, রেফারেল-লিংক (জেলা হাসপাতাল/বিশেষায়িত কেন্দ্র)।
৩. জাতীয় ড্যাশবোর্ড—রিয়েল-টাইম মনিটরিং
DHIS2–তে হাইপারটেনশন/ডায়াবেটিস কেস-রেজিস্ট্রি, কন্ট্রোল রেট ও লস্ট-টু-ফলোআপ ট্র্যাক করা।
৪. ঝুঁকিকারক নীতিনির্ধারণ
লবণ হ্রাস কর্মসূচি (বাল্ক সল্টে সোডিয়াম টার্গেট, গণরন্ধনে লো-সোডিয়াম, হাই-সোল্ট ফুডে রিফর্মুলেশন); ফ্রন্ট-অফ-প্যাক (FOP) সতর্কতামূলক লেবেল; চিনিযুক্ত পানীয় (SSB) কর—প্রাইস পলিসির মাধ্যমে আচরণ বদল।
৫. তামাক নিয়ন্ত্রণের আপডেটেড আইন পাস ও বাস্তবায়ন
DSA–মুক্ত ১০০% পাবলিক স্পেস, পয়েন্ট-অফ-সেল ডিসপ্লে নিষেধ, সিঙ্গেল স্টিক বিক্রি নিষেধ, ই–সিগারেট/ENDS–এর পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ, অর্থমন্ত্রকের সাথে সমন্বিত কর কাঠামো (অ্যাড ভ্যালরেম + নির্দিষ্ট).
৬. বায়ুদূষণ কমাতে ‘হেলথ-ইন-অল-পলিসিস’
ইটভাটা, নির্মাণসাইট, ট্রাফিক ইমিশন নিয়ন্ত্রণ; সিটি কর্পোরেশনের সাথে ‘ক্লিন এয়ার প্ল্যান’—কারণ PM₂.₅ NCD ঝুঁকিকে বহুগুণ বাড়ায়।
৭ ক্যান্সার কেয়ার রোডম্যাপ
সার্ভিক্যাল ক্যান্সার স্ক্রীনিং (HPV-ভিত্তিক), HPV টিকাদানের বিস্তার; জেলা-স্তরে কিমো/রেডিওথেরাপি অ্যাক্সেস বাড়ানো।
৮. স্কুল–ওয়ার্কপ্লেস হেলথ
স্কুল ক্যান্টিন পলিসি (লো-সল্ট/লো-ট্রান্স ফ্যাট); নিয়মিত শারীরিক শিক্ষা; কর্মক্ষেত্রে BP/গ্লুকোজ স্ক্রীনিং।
৯. ডিজিটাল হেলথ ও টেলিমেডিসিন
ফলোআপ/ঔষধ রিফিল রিমাইন্ডার, SMS–ভিত্তিক সল্ট/তামাক/অ্যাক্টিভিটি বার্তা।
১০.গবেষণা–সার্ভেইলেন্স
STEPS ২০২৫/২৬ পুনরাবৃত্তি; BDHS–এ NCD বায়োকেমি বর্ধিতকরণ; এয়ার কোয়ালিটি–হেলথ লিঙ্কেজ।
বেসরকারি খাত ও নাগরিকসমাজের ভূমিকা
Diabetic Association of Bangladesh (BADAS/BIRDEM): দেশজুড়ে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক—৬১টি অ্যাফিলিয়েটেড অ্যাসোসিয়েশনসহ—ডায়াবেটিস কেয়ারের বৃহৎ অংশ তারা বহন করে; বিগত বছরগুলোতে হাসপাতাল/ইনস্টিটিউট ও একাডেমিয়ার মাধ্যমে সক্ষমতা তৈরি করেছে।
icddr,b ও অংশীদাররা: কমিউনিটি-ভিত্তিক উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, কস্ট-ইফেক্টিভ মডেল, এবং পলিসি ডায়ালগ—স্কেল-আপের জন্য প্রমাণ জোগাচ্ছে।
মিডিয়া/সিভিল সোসাইটি: ট্রান্স ফ্যাট, তামাক সংশোধনী, SSB কর, বায়ুদূষণ—এ সব এজেন্ডায় এডভোকেসি জোরদার।
সামাজিক সচেতনতা ও ব্যাপক প্রচারণা—কি বলবে বাংলাদেশ
“নুন কমান, জীবন বাড়ান”—গৃহস্থালি ও রেঁস্তোরায় লবণ কমানোর আহ্বান; রান্নায় মেপে লবণ।
“প্রতিদিন ৩০ মিনিট হাঁটা/সাইক্লিং/খেলাধুলা”—ওয়ার্কপ্লেসে ‘অ্যাক্টিভ ব্রেক’।
“তামাক ছাড়ি আজই”—Quitline/SMS–সাপোর্ট, ক্লিনিকাল ব্রিফ অ্যাডভাইস; ই-সিগারেটের ঝুঁকিও জানানো (আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি আছে)।
“ফল–সবজি ৫ সার্ভিং”—বিকেলের নাস্তা বদলে ফল/ডাল/চিঁড়া; স্কুল ক্যান্টিনে ‘রেড–অ্যাম্বার–গ্রিন’ লেবেল।
“পরিষ্কার বায়ু—সবার অধিকার”—মাস্ক/ইনডোর ভেন্টিলেশন, কমিউনিটি ট্রি-প্ল্যান্টিং, স্থানীয় দূষণ-সূত্রে নাগরিক নজরদারি।
৫–১০ বছরের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা (টার্গেট সহ)
জাতীয় লক্ষ্য (SDG 3.৪–এর সাথে সামঞ্জস্য): ২০৩০-এর মধ্যে NCD–জনিত ‘premature’ মৃত্যুহার ১/৩ কমানো।
টার্গেট/ইন্ডিকেটর (উদাহরণ):
হাইপারটেনশনের কন্ট্রোল রেট ≥৫০% (বর্তমানে নিম্ন); ডায়াবেটিসে HbA1c <৭% ≥৫০%।
তামাক ব্যবহার ২৫% কমানো; SSB কর বাস্তবায়ন; TFA–ফ্রি খাদ্য পূর্ণাঙ্গ নজরদারি।
শহরভিত্তিক ক্লিন এয়ার অ্যাকশন প্ল্যান ও PM₂.₅ বার্ষিক গড় <৩৫ µg/m³ লক্ষ্যমাত্রা।
STEPS/BDHS–এ দুই বছরে একবার NCD–কোর সূচক আপডেট।
সরকারের দায়িত্ব ও মন্ত্রণালয়–সমন্বয় কাঠামো (প্রস্তাব)
স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ (লিড): MSAP আপডেট (২০২৬–২০৩০), PHC–PEN স্কেল-আপ, ওষুধ–ডায়াগনস্টিক–রেজিস্ট্রি।
অর্থ/এনবিআর: তামাক ও SSB–তে ট্যাক্স রিফর্ম; স্বাস্থ্যকর খাবারে ট্যাক্স ইনসেনটিভ।
শিক্ষা: স্কুল হেলথ কারিকুলাম, ক্যান্টিন স্ট্যান্ডার্ড, HPV ভ্যাকসিন রোলআউট সমর্থন।
শিল্প/বাণিজ্য/খাদ্য নিরাপত্তা (BFSA): ট্রান্স ফ্যাট ২% নীতি নজরদারি; প্যাকেট লেবেলিং স্ট্যান্ডার্ড; নুন/চিনি রিফর্মুলেশন।
তথ্য/বেতার-টিভি: জাতীয় ‘NCD মিডিয়া ফ্রেমওয়ার্ক’—ভেরিফায়েড স্বাস্থ্যবার্তা।
স্থানীয় সরকার/সিটি কর্পোরেশন: হাঁটাপথ/সাইকেল লেন/পার্ক; রাস্তার ধুলা দমন; খোলা জায়গায় ধূমপানমুক্তি বাস্তবায়ন।
সড়ক পরিবহন/পরিবেশ/পাওয়ার: ক্লিন ফুয়েল, যানবাহন এমিশন স্ট্যান্ডার্ড, ইটভাটা আপগ্রেড।
সমাপনী কথা
বাংলাদেশে NCD–এর ঢেউ থামাতে ক্লিনিকাল কেয়ার + জনস্বাস্থ্য নীতি + সামাজিক আচরণ বদল—এই তিন স্তম্ভে একযোগে কাজ লাগবে। আমাদের কাছে নীতি–রোডম্যাপ আছে (MSAP), প্রাইমারি কেয়ারে প্ল্যাটফর্ম আছে (NCD Corner), শক্তিশালী নাগরিকসমাজ আছে (BADAS/icddr,b/NGO). এখন দরকার ডেলিভারি–ডিসিপ্লিন—ডাটা দেখে কাজ করা, টার্গেট বেঁধে মনিটরিং করা, এবং আইনের বাস্তবায়নে আপস না করা।
তথ্যসূত্র (নির্বাচিত)
১. WHO–Bangladesh: National STEPS Survey 2018 (ঝুঁকিকারক প্রাদুর্ভাব).
২. World Bank/WHO: NCD deaths (% of total), Bangladesh (২০১৯ ≈ ৭০%).
৩. WHO Country Story (Bangladesh): NCD–এ ৬৭% মৃত্যু, ‘premature’ মৃত্যুঝুঁকি.
৪. IDF Diabetes Atlas / Bangladesh (২০২৪): প্রাদুর্ভাব ১৩.২%, ~১.৩৯ কোটি রোগী.
৫. IQAir World Air Quality Report 2024: বাংলাদেশ #2, PM₂.₅=৭৮ µg/m³.
৬ Multisectoral Action Plan for NCDs, Bangladesh ২০১৮–২০২৫ (সরকারি নথি).
৭. NCD Corner—নীতিপত্র ও মূল্যায়ন.
৮ ট্রান্স ফ্যাট ২% সীমা (BFSA)—নীতি ও প্রতিবেদন.
্৯. Tobacco Control—আইন ও সাম্প্রতিক আপডেট (ই-সিগারেট আমদানি নিষেধ).
১০. World Bank: NCD–Continuum of Care—অর্থনৈতিক–সার্ভিস গ্যাপ.
১১. BADAS/BIRDEM নেটওয়ার্ক (অ্যাফিলিয়েশন/ইনফ্রাস্ট্রাকচার).