বাংলাদেশ: বহুমাত্রিক এক সমন্বিত মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গি / ইকবাল জিল্লুল মজিদ(পরিচালক কমিউনিটি হেলথ প্রোগ্রাম,রাডডা এমসিএইচ এফপি সেনটার মিরপুর ঢাকা)
প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ—ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দারিদ্র্য, বেকারত্ব, শিক্ষার বৈষম্য, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতি, স্বাস্থ্য সমস্যা, পরিবেশ সংকট, সাইবার অপরাধ, নারী ও শিশু নির্যাতন, সামাজিক অবক্ষয়—সবকিছু মিলিয়ে যেন এক বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। এসব সমস্যাকে কেবল অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে পূর্ণাঙ্গ সমাধান সম্ভব নয়। বরং মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ—মানুষের চিন্তাধারা, আচরণ, আবেগ ও মূল্যবোধের আলোকে বোঝা প্রয়োজন।
সমাজ ও জনগোষ্ঠীর মানসিক বাস্তবতা
শিক্ষার্থী ও তরুণ সমাজ: প্রতিযোগিতা, বেকারত্বের চাপ, নেশা ও কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি তরুণদের হতাশাগ্রস্ত করছে। তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ভেঙে পড়ছে, স্বপ্ন ভাঙছে।
নারী জনগোষ্ঠী: গার্হস্থ্য সহিংসতা, যৌন হয়রানি, কর্মক্ষেত্রে বৈষম্য—সবই তাদের মনে ভয়, ক্ষোভ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করছে।
গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠী: দারিদ্র্য ও ক্ষুধার কারণে তাদের মধ্যে অসহায়ত্বের মানসিকতা প্রবল। আবার সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ায় উদ্যোগশক্তি হ্রাস পাচ্ছে।
শ্রমজীবী মানুষ: অতিরিক্ত কাজ, কম মজুরি, অস্থিরতা—সব মিলিয়ে তাদের মানসিক চাপ বেড়ে যায়, যার প্রভাব পড়ে পরিবার ও সামাজিক সম্পর্কে।
ধনাঢ্য ও প্রভাবশালী গোষ্ঠী: আর্থিক নিরাপত্তা থাকলেও ভোগবাদী মানসিকতা, প্রতিযোগিতামূলক অহংকার ও রাজনৈতিক টানাপোড়েন তাদের ভেতরে এক ধরনের অসন্তোষ ও নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করে।
বয়স্ক ও প্রবীণ জনগোষ্ঠী: পারিবারিক অবহেলা, একাকীত্ব, আর্থিক অনিশ্চয়তা তাদের মানসিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলে দেয়।
সমস্যাগুলোকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে দেখা
১. রাজনৈতিক অস্থিরতা – নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব জনগণের মাঝে হতাশা, বিভাজন ও ভীতির জন্ম দেয়।
২. দুর্নীতি – নৈতিক অবক্ষয় বাড়ায়, সৎ মানুষকে নিরুৎসাহিত করে।
৩. দারিদ্র্য ও বৈষম্য – অবহেলা ও হীনমন্যতার জন্ম দেয়।
৪. শিক্ষার সংকট – শিশু ও তরুণদের মনে হতাশা ও বিভ্রান্তি তৈরি করে।
৫. স্বাস্থ্য সমস্যা – শারীরিক অসুস্থতা মানসিক চাপকে দ্বিগুণ করে।
৬. প্রাকৃতিক দুর্যোগ – মানুষের মনে ভয়, অনিশ্চয়তা ও ট্রমার সৃষ্টি করে।
৭. নারী ও শিশু নির্যাতন – পুরো সমাজে আস্থার সংকট তৈরি করে।
৮. সাইবার অপরাধ – নতুন প্রজন্মের মধ্যে ভয়, আক্রমণাত্মকতা ও মানসিক ভারসাম্যহীনতা ছড়ায়।
৯. পরিবেশ সংকট – ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের উদ্বেগ তৈরি করছে।
আদর্শ সমাধানমুখী মনস্তত্ত্ব
শিক্ষায় মূল্যবোধ: প্রতিটি স্তরে মানবিক শিক্ষা, নৈতিকতা ও মনোবিজ্ঞানের মৌলিক শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।
সামাজিক সংহতি: ধনী-গরিব, শহর-গ্রাম, নারী-পুরুষ সবার মধ্যে সহযোগিতা ও সহমর্মিতা জাগাতে হবে।
রাজনীতির সংস্কার: দলীয় বিভাজনের পরিবর্তে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা জরুরি।
মানসিক স্বাস্থ্যসেবা: স্কুল-কলেজ, কর্মক্ষেত্র, গ্রাম ও শহরে কাউন্সেলিং কেন্দ্র ও হেল্পলাইন বাড়ানো প্রয়োজন।
নারী ও শিশুর নিরাপত্তা: মানসিক সহায়তা, আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি ও আইনি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
বয়স্ক সেবা: প্রবীণদের মানসিক সুস্থতা রক্ষায় পরিবার ও রাষ্ট্র উভয়ের যত্ন নেওয়া জরুরি।
তরুণদের বিকাশ: খেলাধুলা, সংস্কৃতি, উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
শেষকথা
বাংলাদেশের সমস্যাগুলো অর্থনৈতিক বা অবকাঠামোগত সমাধান দিয়েই শেষ হবে না। মূল চাবিকাঠি হলো মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জাগরণ। নাগরিকদের মাঝে আত্মবিশ্বাস, সহমর্মিতা, নৈতিকতা, দায়িত্ববোধ ও ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে পারলেই দেশের সব জনগোষ্ঠী মিলে এক নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারবে।
সংগৃহীত – আমির হোসেন